২৬ বছর কারাভোগ শেষে পিয়ারা বললেন, বোনকে হ’ত্যা করিনি

2032

আমার স্কুলে দারোগা গিয়া বলে পিয়ারা কে? বলি আমি। দারোগা বলেন, তোমার বোন পুকুরে ডুবে মা’রা গেছে, তুমি জানো? আমি বলি, স্যার আমি এসব কিছুই জানি না।

এরপর আমাকে মঠবাড়িয়া থানায় নিয়া যায়। দারোগা অনেক কথা বলে, ভ’য় দেখায়। বলে আমি যদি না বলি আমার বোনকে পুকুরে ফেলে দিয়েছি তাহলে আমাকে ছাড়বে না।

দারোগার শেখানো কথা আমি সবার কাছে বলি। এরপর আমার জেল হয়। আসলে আমি আমার বোনকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলি নাই। তার মৃ”ত্যু”র বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।

কথাগুলো বলছিলেন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরুখারী গ্রামের ছোট হারজি গ্রামের মৃত আনিস মৃধার ছোট মেয়ে ৩৮ বছর বয়সী পিয়ারা আক্তার।


২৬ মার্চ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দারের বিশেষ বিবেচনায় চার বছর দণ্ড মওকুফের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তি পান পিয়ারা আক্তার। মুক্তির পর (২৫ জুন) শুক্রবার এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আমার জীবনের আর কিছুই রইল না। যাবজ্জীবন কা’রা’দ’ণ্ড ভোগ করেছি। যখন আমাকে পুলিশ গ্রে’ফতার করেছিল তখন আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। সালটা ছিল ১৯৯৫। স্কুলে একটি অনুষ্ঠান ছিল। সকাল বেলা উঠে আমি স্কুলে চলে যাই। স্কুলের ক্লাশেই ছিলাম।

আমাকে গিয়ে পুলিশের দারোগা বলেন, আমার চাচাতো বোন মেহজাবিন আক্তার পুকুরে ডুবে মা”রা গেছে। আমি তার মুখেই শুনি মেহজাবিনের মৃ’ত্যু’র খবর।

বিশ্বাস করেন, আমি কিছুই জানতাম না। পুলিশের সেই দারোগার নাম স্মরণ নেই উল্লেখ করে বলেন, তখনতো ছোট ছিলাম। তার নাম মনে নেই। কালো ও মোটা ছিলেন। তিনি অনেক পান খেতেন।

তাহলে কেন আপনাকে যা’ব’জ্জী’ব’ন কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হলো? এ প্রশ্নের জবাবে পিয়ারা বলেন, দারোগা আমাকে শিখিয়ে দেন যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলি, বোনকে পুকুরে ধা’ক্কা মে’রে আমি ফেলে দিয়েছি তাহলে সেদিনই আমাকে ছেড়ে দিবে।

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার (দারোগা) শেখানো কথাই বলেছি। কিন্তু আমাকে ছাড়েনি। তখন আমাকে পিরোজপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে ছিলাম দুই বছর।

১৯৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল আমাকে যাবজ্জীবন কা’রা’দ’ণ্ড দেন। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসা হয় বরিশাল কারাগারে। আর এখানে ২৬ বছর কারাভোগ করেছি। আরও চার বছর ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসক স্যার বিবেচনা করে সাজা মওকুফ করে দিয়েছেন।

পিয়ারা বলেন, আমার চাচাতো বোন পানিতে ডুবে মা’রা গিয়েছিল সত্য। কিন্তু আমার আব্বার সঙ্গে বড় চাচা জহুরুল হক মৃধা ও চাচাতো ভাই সত্তার মৃধার জমি নিয়ে বি’রো’ধ চলছিল।

আমাদের জমি দিচ্ছিলেন না চাচা। পরে বুঝতে পেরেছি, মেহজাবিনের মৃ”ত্যু”র ঘটনায় তারা আমাদের ফাঁ’সি’য়ে’ছে। ওই জমি আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি।

বিশেষ বিবেচনায় নির্ধারিত সময়ের চার বছর আগে ২০২১ সালের ১০ জুন কারাগার থেকে মুক্তি পান পিয়ারা আক্তার। এরপর মঠবাড়িয়ায় ফিরে গিয়ে দেখেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা মা ছফুরা বেগম একাই বসবাস করছেন।

বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। আর ভাই দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছেন। সেও আলাদা থাকেন। এখন আর করার মতো কিছুই নেই পিয়ারার।

আফসোস করে বলেন, আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আমার ভাইয়েরা যতটুকু সম্পত্তি ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হয়নি। এখনতো আমরা নিঃস্ব। জীবন শেষ হইয়া আসছে। আর কয়ডা দিন বাচমু। নামাজ-রোজা করা ছাড়া আমার আর কোনো কিছুর ইচ্ছা নেই।

পিয়ারা বলেন, বরিশালের জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে ডেকে পাঠাইছে। বৃহস্পতিবার একটি সেলাই মেশিন দিয়েছে। এখন বরিশালে একজনের বাসায় আছি। রোববার জেলা প্রশাসনে যাইতে বলছে। তিনি নাকি আমাকে একটি চাকরি দেবেন। এখন গিয়ে দেখি কি চাকরি দেয়। আমার শরীর তো আর ভালো নেই, চাকরি কি করতে পারমু?

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, পিয়ারা আক্তার তখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ভালো-মন্দ কিছু বুঝে উঠার আগেই জীবনের অনেক সময় পার করেছেন চার দেয়ালের মাঝে। দীর্ঘ ২৬ বছর কারাভোগের পর বন্দি জীবনের অবসান ঘটেছে তার।

আমরা কাউকেই অপরাধীর চোখে দেখি না। আসলে অপরাধী হয়ে কেউ জন্মায় না। কেউ কেউ আছেন বিনা অপরাধে জেল খাটেন। আমরা অনেক বার এর প্রমাণ পেয়েছি। যথাযথ প্রমাণের অভাবে হয়তো তাদের জেল খাটতে হয়েছে।

পিয়ারা আক্তার প্রসঙ্গে বলেন, পেয়ারা আক্তার ২৬ বছর জেল খেটেছে। এখন তার থাকা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি আমরা। তিনি যেন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন সেই চেষ্টা করছি।