আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য পবিত্র নিদর্শন রাজির মধ্যে পবিত্র কাবা শরিফের পরেই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র নিদর্শন পবিত্র মসজিদে নববী (সা.)।
মহিমান্বিত এ মসজিদে নববী অর্থ নবীজির মসজিদ। এই মসজিদটিই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোত্তম ও পবিত্র স্থানের মধ্যে দ্বিতীয়।
যেথায় মহব্বত সহকারে এক রাকাত নামাজ পড়লে ৫০ হাজার রাকাত কবুল হওয়া নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়। এ মসজিদের গুরুত্ব ও মর্যাদা নিয়ে কোরআন-হাদিসের অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে।
যেটি সৌদি আরবের মদিনায়ে মুুনাওয়্যারায় অবস্থিত। এই মসজিদের অভ্যন্তরে দক্ষিণে অবস্থিত হযরত (সা.)-এর নূরানী রওযায়ে আক্দাস শরিফ। যা পবিত্র খানায়ে কা’বার পর পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থান হিসেবে স্বীকৃত।
সৌদি আরবের মদিনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ মসজিদটি হজরত মুহাম্মদ সা: নিজ হাতে নির্মাণ করেন। মসজিদের নির্মাণকাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার বছর ৬২২ সালে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বসবাসের ঘর।
মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে রয়েছে একটি সবুজ গম্বুজ। গম্বুজটি নবীর মসজিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কারণ এ গম্বুজের নিচেই রয়েছে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর রওজা মোবারক। হজরত মুহাম্মদ সা: মসজিদের পাশে যে ঘরে ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
পরে মসজিদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে তার রওজা মোবারক মসজিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রওজা মোবারকের ওপরে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। ১২৭৯ সালে প্রথম এখানে একটি কাঠের গম্বুজ নির্মাণ করা হয় এবং পরে অনেকবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয় এটি।
বর্তমানে যে গম্বুজটি দেখা যাচ্ছে সেটি নির্মিত হয় ১৮১৮ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের সময়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত লাভের পর মসজিদে নববীকে তৃতীয় মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পথে মদিনা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কুবা নামক স্থানে হজরত মুহাম্মদ (সা.) একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।
এটিকেই সে সময়ে প্রথম মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য ইরিত্রিয়ার মাসওয়ায় অবস্থিত সাহাবা মসজিদকেও কেউ কেউ নবীর সময়ে নির্মিত প্রথম মসজিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা হোক কুবা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন এবং নবীর মসজিদের সরাসরি নির্মাণ কাজে অংশ নেন রাসূলে পাক সা:।
বর্তমানে মুসলমানদের কাছে পবিত্র কাবার পর মসজিদে নববীকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। হাজীরা সবাই পরিদর্শন করেন এ মসজিদ।
কারণ এ মসজিদের মধ্যে রয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর রওজা মোবারক। মক্কা থেকে হিযরতের পর জীবনের বাকি বছরগুলো মদিনাতেই কাটান তিনি।
তবে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সময়ে নির্মিত মসজিদের অবকাঠামো বর্তমানে বিদ্যমান নেই। শুরুতে মসজিদটি ছিল মূলত দেয়াল ঘেরা একটি খোলা স্থান। ওহী তথা কুরআন নাজিলে, মানুষের সম্মিলন স্থান এবং বিচার ফয়সালা সম্পন্ন হতো এখানে।
কুরআন শেখার জন্য একটি উঁচুস্থান ছিল। মসজিদের কিছু অংশে ছাদের ব্যবস্থা ছিল যার খুঁটি ছিল খেজুর গাছের। আর কিবলা ছিল জেরুসালেমের দিকে। পরে কুরআনে কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাজিল হলে কিবলাও পরিবর্তন করা হয়।
মসজিদটি যে স্থানে নির্মিত হয় তার এক অংশে খেজুর শুকানো হতো। মালিক ছিলেন সাহল ও সুহাইল। মসজিদ নির্মাণের জন্য তারা এটি দান করতে চাইলে হজরত মুহাম্মদ সা: দান গ্রহণ না করে কিনে নেন। প্রথমে মসজিদটির আয়তন ছিল ১০০/১১৬.৯ ফুট। দেয়ালের উচ্চতা ১১.৮ ফুট। মসজিদের তিনটি দরজা ছিল।
খায়বার যুদ্ধের পর মসজিদ চার দিকে সম্প্রসারণ করা হয়। পশ্চিমে তিন সারি খুঁটি নির্মাণ করা হয় এবং এ স্থান সালাতের জন্য ব্যবহার করা হয়। এরপর হজরত উমরের (রা:) সময় এ মসজিদ সম্প্রসারণ করা হয়।
হজরত উসমানের (রা:) সময় ৬৫৯ সালে পুরো মসজিদ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। খেজুর গাছের খুঁটির পরিবর্তে পাথরের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। এভাবে পরে বিভিন্ন সময় সংস্কার আর সম্প্রসারণ চলতে থাকে।
৭০৭ সালে উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক মসজিদে নববীর ব্যাপক সংস্কার করেন। তিন বছরব্যাপী ব্যয়বহুল সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদের চার দিকে চারটি মিনারও নির্মাণ করা হয় প্রথমবারের মতো। নির্মাণকাজে তিনি বাইজানটাইন থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র আনয়ন করেন।
মসজিদের মধ্যে দেয়াল দিয়ে নবীর স্ত্রীদের ঘরগুলোকেও আলাদা করা হয় এ সময়। এরপর আব্বাসীয় খলিফাদের সময়ও মসজিদের সংস্কার চলতে থাকে। ১৪৭৬ সালে মসজিদের গম্বুজটি পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়। ১৮৩৭ সালে গম্বুজটিতে সবুজ রঙ করা হয়।
১৮৫৯ সালে উসমানীয় সুলতান আব্দুল মাজিদ ১৩ বছরব্যাপী মসজিদ সংস্কার শুরু করেন। এ সময় মসজিদের স্থাপত্যশৈলী, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি করা হয়। ব্যবহার করা হয় অনেক দামি জিনিসপত্র।
১৯৩২ সালে বর্তমান সৌদি রাজ পরিবারের শাসন প্রতিষ্ঠার পর মসজিদের ব্যাপক সংস্কার, সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়ন করা হয়। বাদশা ইবনে সৌদ, বাদশা ফয়সাল, বাদশা ফাহাদ প্রত্যেকের সময়ই বিপুল অর্থ ব্যয়ে মসজিদ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়।
২০১২ সালে ঘোষণা করা হয় ছয় বিলিয়ন ডলারের সম্প্রসারণ প্রকল্প, যা শেষ হলে মসজিদে মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা হবে সর্বোচ্চ ২০ লাখ।
মসজিদে নববীর স্থাপত্য শৈলী, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মূল্যবান দ্রব্যাদির ব্যবহার, সাজসজ্জা আর জৌলুশ, মসজিদ চত্বরের বর্তমান অটোমেটিক ছাতা, অদূরে পাহাড় শ্রেণীসহ আর যত যা কিছুই বর্ণনা করা হোক না কেন কোনো কিছুই এ মসজিদের মূল আকর্ষণ বা সৌন্দর্যের কারণ নয়।
এ মসজিদের প্রাণ, এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ ভালোবাসা আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলো মসজিদের অভ্যন্তরে নবী পাক হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর রওজা মোবারক।
এ মসজিদ চত্বরে পা ফেলতেই যে কারো মনে ভেসে ওঠে এখানেই এক সময় কদম মোবারক ফেলতেন নবী পাক হজরত মুহম্মদ (সা.) এবং তার সাহাবীরা।
আরো কত সহস্র স্মৃতি ভেসে ওঠে মানুষের মনে এ মসজিদের আশপাশের পরিবেশ ঘিরে।