নবীজী সঃ এর কাছে যে সকল বেশে হাজির হতেন জিবরাইল (আ.)

2234

জিবরাইল (আ.) এর উপাধি হলো রুহুল আমিন, তথা বিশ্বস্ত আত্মা। তিনি হলেন আকাশের আমিন। জমিনের আমিন হলেন বিশ্বনবী (সা.)। আকাশের আমিন জিবরাইল (আ.) জমিনের আমিনের কাছে ওহি নিয়ে আসতেন। কোনো কোনো সময় সবার অলক্ষ্যে ওহি নাজিল করে চলে যেতেন। আবার কোনো কোনো সময় মানব আকৃতিতে আগমন করতেন। তিনি প্রায় সময় দাহিয়াতুল কালবি (রা.)-এর আকৃতি ধারণ করে আসতেন।

ফেরেশতা কুকুর ও শূকর ছাড়া যেকোনো আকৃতি ধারণ করতে পারেন। একবার জিবরাইল (আ.) ধবধবে সাদা পোশাকে এবং নিকষ কালো কেশবিশিষ্ট অবস্থায় ছদ্মবেশে মহানবী (সা.)-এর দরবারে এসে হাজির হন।

হাদিস বিশারদদের মতে, দশম হিজরিতে বিদায় হজের কিছুকাল আগে জিবরাইল (আ.) সাহাবায়ে কেরামদের দ্বিন শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁর মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়নি। মহানবী (সা.) তখন সাহাবায়ে কেরাম দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। ওমর (রা.) বলেন, আমাদের কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি।

কোনো কোনো হাদিস বিশারদের মতে প্রথমে মহানবী (সা.)ও চিনতে পারেননি। অবশেষে লোকটি মহানবী (সা.)-এর সামনে এসে এবং স্বীয় হাঁটুদ্বয় মহানবী (সা.)-এর পবিত্র হাঁটুদ্বয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বসে পড়েন। অতঃপর স্বীয় হস্তদ্বয় তাঁর পবিত্র ঊরুদ্বয়ের ওপর রাখেন। সাহাবায়ে কেরাম অবাক হয়ে তাঁর কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন।

পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর ছিলেন আমার নবীজি (সা:)

প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পৃথিবী এমন সভ্য, সুন্দর ছিল না। ছিল জাহিলিয়াতে ঢাকা। কারণ মানুষ তখন ভুলে গিয়েছিল নিজেদের পরিচয়।

ভুলে গিয়েছিল তারা মানুষ। ফলে পশুত্বের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের মন। তারা এতটাই অমানবিক ছিল, নিজের ঔরসজাত সন্তানকেও জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলত।

হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি, কাফেলা লুট, নারী নির্যাতনসহ এমন কোনো মন্দ কাজ নেই, যা তারা করত না।

এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে সমাজব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের জন্য সে ছিলেন এক মহামানব যাঁর নাম মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এক আশ্চর্যময় পরিবর্তন আনেন সমাজে।

ঐশী আলোয় আলোকিত। নূরের চেরাগ জ্বলে। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন আবদুল্লাহ। আর মাতা আমিনা। বাবা-মাহারা শিশু মুহাম্মদ বড় হতে থাকেন দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিবের আদরে। শৈশবেই তিনি সত্যবাদিতা আর সদাচরণে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন।

আমানতদারির বিশ্বস্ততায় উপাধি পান ‘আল-আমিন’ তথা বিশ্বাসী। সেই যুগে মানুষ যখন কারণে অকারণে হত্যা, লুটতরাজ, মদ্যপান, জোয়া, নারী নির্যাতন হীন কর্মকাণ্ডে উন্মাদ হয়ে থাকত, তখন যুবক মুহাম্মদ (সা.) চিন্তামগ্ন থাকতেন মানবতার মুক্তির।

কীভাবে এ বর্বরোচিত সমাজের পরিবর্তন হবে, মানুষ সত্যিকারের মানুষে পরিণত হবে এ ধ্যানেই মগ্ন থাকতেন দিন-রাত। চল্লিশ বছর বয়সে হলেন নবী ও রাসূল। প্রভুর ঐশী বাণীকে মানুষের কাছে তুলে ধরলেন।

দয়ার সাগর নবীজি অবিশ্বাসীদের বিদ্রুপ, অমানুষিক নির্যাতনে ক্ষুব্ধ না হয়ে তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে করুণাময় রবের কাছে তাদেরই জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।

তাদের ভালোবাসা দিয়ে সত্যের পথে ডেকেছেন। কারণ তিনি যে দয়ার নবী আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এসেছে তোমাদের মধ্যকার এমন একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ যার কাছে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, বিশ্বাসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সূরা তাওবা : ১২৮)।

নবীজির এ দয়া নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সব মানুষের জন্যই সমানভাবে ছিল। হোক সে ভিন্ন মতের বা পথের। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশ দিয়ে একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

তিনি তখন তা দেখে দাঁড়ালেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তখন বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আলাইসাত নাফসা? অর্থাৎ সে কি মানুষ নয়? (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩১২)।

নবীজির দয়ামায়া শুধু মানব জাতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাকহীন পশু-পাখির জন্যও ছিল তার দয়ামায়া। তাদের জন্যও নবীজির মমতা ছিল মানুষের মতোই।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা এক সফরে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক সময় একটু প্রয়োজনে দূরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি, সঙ্গে দুটি বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটি ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু মা-পাখিটিও চলে এলো।

বাচ্চা দুটির কাছে আসার জন্য পাখিটি মাটির কাছে অবিরাম উড়ছিল। তখন রাসূল (সা.) এসে পড়লেন। তিনি এটি দেখে বললেন, কে এ বাচ্চা ধরে এনে এদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চা দুটি মায়ের কাছে রেখে এসো। (আবু দাউদ ১৪৬/২)।

এ জন্যই তো নবীজি লক্ষ কোটি হৃদয়ে সুবাসিত ফুল হয়ে আছেন। যা স্বীকার করেছেন মহাত্মা গান্ধীজিও। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, যিনি আজ লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন।

যে কোনো সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে, ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে অন্যের জন্য প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা।

মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাহিত্যিক মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ গ্রন্থে বলেন, ‘মুহাম্মদকে আমি বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছি, এতে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন।

কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ধর্মবহির্ভূত ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবে ও সর্বাধিক সফলকাম হয়েছেন।’ ইংরেজ কবি জন কিটস বলেন, ‘পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।’

নবীজির মূল্যায়নে এ রকম উৎকৃষ্ট উক্তি অসংখ্য মনীষীগণই করে গেছেন। সেই দেড় হাজার বছর আগের বুহাইরা থেকে শুরু করে এখনকার মহাত্মা গান্ধী, সামনে আরও অসংখ্য মনীষীরাও নবীজির শানে এমন উক্তি-উপমা করে যাবেন। কারণ নবীজি এমনই এক ফুল, যে ফুল যুগ যুগ খশবু ছড়ায়।

এমনভাবেই নবীজি পৃথিবীর ইথারে ইথারে মহাসত্যের আলো ছড়িয়ে গেছেন। রোপণ করেছেন মানবতার বীজ। দিয়েছেন আল্লাহ প্রদত্ত সুন্দর একটি জীবন ব্যবস্থা। এরপর এগারো হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখে আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে মদিনা মুনাওয়ারায় শায়িত হয়েছেন।

নবীজি ছিলেন হজরত ইউসুফ (আ.) চেয়েও বহুগুণ সুন্দর। পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোলাকার ছিল নুরানি মুখমণ্ডল। প্রশস্ত কপাল, চিকন ও ঘন ভ্রু, দুই ভ্রুর মাঝখানে একটা উঁচু রগ ছিল। কবির ভাষায়, ‘যখন বুলাই তার মুখমণ্ডলে দু’চোখ/ সে যেনো বর্ষামুখী মেঘে বিদ্যুতের চমক।’ গোলাপের পাপড়ির মতো তাঁর ঠোঁটদ্বয়ে প্রায়শই লেগে থাকত ফুলের হাসি। গমের মতো লালচে সাদা ছিল আমার নবীর গায়ের রং।